হাওজা নিউজ এজেন্সি: তার নাম আবদুস সালাম ইবনে সালেহ ইবনে সুলাইমান ইবনে আইয়ুব ইবনে মাইসারাহ এবং তিনি আবা সালত হেরাভি নামে পরিচিত। বলা হয়ে থাকে যে, আবাসালতের প্রথম বা দ্বিতীয় পূর্বপুরুষ হেরাত শহরে বসবাস করতেন। ফতেহের সময় তিনি বন্দী হন এবং হেজাজে নিয়ে যাওয়া হয়। তাকে আবদুর রহমান ইবনে সামুরা কুরাইশির ক্রীতদাস হিসেবে প্রদান করা হয়। এজন্য ঐতিহাসিকরা আবা সালতকে আবদুর রহমান ইবনে সামুরার মাওয়ালি হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তার সবচেয়ে পরিচিত উপাধি “হেরাভি”, যা শিয়া ও সুন্নি উভয়ের মধ্যেই ব্যবহৃত হয়েছে এবং এটি তার পূর্বপুরুষদের বাসস্থানের প্রতি ইঙ্গিত করে। এছাড়াও তাকে “কুরাইশি”, “আবশামি”, “নিশাপুরি”, “বাসরি” এবং “খোরাসানি” উপাধিতেও ডাকা হয়েছে।
তার জন্ম তারিখ সুনির্দিষ্ট নয়, তবে নিজের বক্তব্য অনুযায়ী, তিনি শৈশব থেকেই ৩০ বছর সাফিয়ান ইবনে উয়াইনাহর (মৃত্যু ১৯৮ হিজরি) সান্নিধ্যে ছিলেন। এই তথ্যের ভিত্তিতে তার জন্ম আনুমানিক ১৬০ হিজরিতে ধরে নেওয়া হয়। একটি বর্ণনা অনুযায়ী, তিনি মদিনায় জন্মগ্রহণ করেন এবং নিশাপুরে বসবাস করেন। তিনি ২৩৬ হিজরির ১৪ শাওয়াল, বুধবার ইন্তেকাল করেন।
অধিকাংশ ইমামিয়া আলেম আবাসালতকে ইমাম রেযার (আ.) সঙ্গী হিসেবে গণ্য করেছেন। যদিও সুন্নি উৎসগুলোর বেশিরভাগই তাকে ইমাম রেযার (আ.) খাদেম হিসেবে উল্লেখ করেছে। কিন্তু ইমামিয়া আলেমদের মধ্যে মুকাদ্দাস আরদাবিলি ছাড়া কেউ তাকে খাদেম বলে অভিহিত করেননি। সম্ভবত, আবাসালতের জ্ঞানতত্ত্ব এবং হাদিসের ক্ষেত্রে অবদান তার খাদেম পরিচয়ের চেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেছিল বলে ইমামিয়া আলেমরা তাকে খাদেম বলে উল্লেখ করেননি।
আবাসালত নিশাপুরে ইমাম রেযার (আ.) সেবা করেছেন এবং ইরানের সরখসেও তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। ইমাম রেযার (আ.) নিশাপুরে আগমনের সময় আবাসালত তার থেকে সিলসিলায়ে -যাহাব হাদিসটি বর্ণনা করেন। ইমাম রেযার (আ.) শাহাদাতের ঘটনার অধিকাংশ বর্ণনাই আবাসালতের মাধ্যমে এসেছে।
এই বিষয়ে সন্দেহ নেই যে, আবাসালত মোহাম্মদ ইমাম রেযার (আ.) সাথে সাক্ষাৎ করেছিলেন। কারণ, যখন ইমাম আলী ইবনে মুসা রেযা (আ.) শাহাদাতের শয্যায় ছিলেন, তখন মোহাম্মদ ইবনে আলী মদিনা থেকে ইরানের তুস শহরে এসে উপস্থিত হন এবং তার সঙ্গে আবাসালতের আলোচনা হয়। ইমাম রেযার (আ.) শাহাদাতের পরেও মোহাম্মদ ইবনে আলী এবং আবাসালতের মধ্যে দুইবার সাক্ষাতের কথা বর্ণিত হয়েছে। একবার, যখন মোহাম্মদ ইবনে আলী ইমাম রেযার (আ.) পবিত্র দেহের ওপর নামাজ আদায় করেন এবং আরেকবার, যখন আবাসালতকে মামুনের নির্দেশে বন্দি করা হয় এবং মোহাম্মদ ইবনে আলী ইবনে মুসার অলৌকিকতার মাধ্যমে আবাসালত মুক্তি পান।
জ্ঞান অর্জনের জন্য আবা সালত ইরাক, হেজাজ এবং ইয়েমেনসহ বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণ করেন। তিনি হাম্মাদ ইবনে যায়েদ, আতা ইবনে মুসলিম, মুতাজ ইবনে সুলাইমান, আবদুর রাযাক সানানি, মালেক ইবনে আনাস, ফুজাইল ইবনে ইয়াজ এবং আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারকের কাছ থেকে হাদিস শ্রবণ করেন। আবাসালত কিছুদিন বাগদাদে হাদিস বর্ণনা করেন। মামুনের শাসনকালে তিনি যুদ্ধের উদ্দেশ্যে মারভে যান। সেখানে খলিফার সভায় অংশ নিলে মামুন তার কথা শুনে মুগ্ধ হন এবং তাকে ঘনিষ্ঠ সঙ্গী হিসেবে গ্রহণ করেন। আবাসালত মুরজিয়া, জাহমিয়া, জিন্দিক এবং কদরিয়াদের খণ্ডনের জন্য প্রচেষ্টা চালাতেন এবং মামুনের উপস্থিতিতে তিনি বারবার বশর মারিসির সঙ্গে বিতর্কে অংশ নিতেন।
আবু সালত হারভি শিয়া রেজালশাস্ত্রবিদদের নিকট সম্পূর্ণ বিশ্বস্ত ব্যক্তি হিসেবে গণ্য হন। সুন্নি রেজালশাস্ত্রবিদদের মধ্যে ইয়াহইয়া বিন মাঈন, আজলি ও ইবন শাহিন তাকে বিশ্বস্ত বলে উল্লেখ করেছেন। তবে অন্য কিছু রেজালশাস্ত্রবিদ যেমন জুজজানি, নাসাঈ, আবু হাতেম রাজি, আকিলি, ইবন হিব্বান, ইবন আদি এবং দারাকুতনি তাকে দুর্বল বলে বিবেচনা করেছেন। আবু সালত বহু হাদিস ইমাম রেযার (আ.) থেকে বর্ণনা করেছেন, যার বেশিরভাগ শেখ সাদুক "ঊয়ুনু আখবারুর রেজা", "আল-আমালী" এবং "খিসাল" নামক গ্রন্থগুলোতে সংগ্রহ করেছেন। আবু সালতের বর্ণনা থেকে উপকৃত হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে তার পুত্র মুহাম্মদ, আহমদ বিন ইয়াহইয়া বালাযরি, আবদুল্লাহ বিন আহমদ আবি খুসাইমা, আবু বকর ইবনে আবি আল-দুনিয়া, ইয়াকুব ইবনে সুফিয়ান বাসাভি, সাহল বিন জানজালা, আহমদ বিন মনসুর রামাদি এবং আব্বাস বিন মুহাম্মদ দুরি উল্লেখযোগ্য। এসব বর্ণনার কিছু "মুসনাদ আবু সালত" নামক গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে, যা আয়াতুল্লাহ সুবহানির ভূমিকা সহ প্রকাশিত হয়েছে।
যদিও আবু সালত আলী বিন মুসা রেজার সঙ্গী হিসেবে বিবেচিত, তার ধর্মীয় পরিচয় নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। একদিকমুহাদ্দিসগণ তার শিয়াপন্থী হওয়ার কারণে শুধু তাকে সমালোচনা করেছেন। এরা তার সুন্নি হওয়া অস্বীকার করেছেন এবং শিয়া ঝোঁকের জন্য তার প্রতি অবহেলা ও কখনো কখনো অবমাননাকর আচরণ করেছেন।
ইমাম রেযার (আ.) মৃত্যুর ৩৩ বছর পর ২৩৬ হিজরীতে শাওয়াল মাসের শেষের দিকে আবু সালত হারভি খোরাসানে ইন্তেকাল করেন। বর্তমানে, তার নামে একটি সমাধি "খাজা আবু সালত" নামে পরিচিত, যা মাশহাদের পূর্ব দিকে শহরের বাইরে ৫ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত। কুম এবং সেমনান শহরেও তার নামে সমাধি রয়েছে। মাশহাদের খাজা আবু সালতের সমাধি, তার গম্বুজ এবং চত্বর, কারবালায়ি মুহাম্মদ আলি দরবিশের প্রচেষ্টায় এবং জনসাধারণের সহায়তায় পুনর্নির্মাণ করা হয়েছে।
কিছু সুফি, যেমন দরবিশ আলি (মৃত্যু ৭২৬ হিজরি) তার সমাধির পাশে দাফন করা হয়েছে। সমাধির মূল ভবনটি চারকোণা এবং এটি চার দিক থেকে চারটি দরজার মাধ্যমে বাইরের সাথে সংযুক্ত। এই ভবনে সাত রঙের টাইলসের নকশা, আয়তাকার দুটি রাওয়াক এবং আয়না খচিত কাজ রয়েছে।
একটি বর্ণনা অনুযায়ী, আবু সালতের সমাধি তার পৈতৃক শহর হেরাতে অবস্থিত। তিনি আব্বাসীয় শাসকদের কাজকর্ম সম্পর্কে বক্তৃতা ও প্রকাশ এবং আহলে বাইতের প্রশংসায় অনেক হাদিস বর্ণনা করার কারণে মামুনের নির্দেশে বন্দী হন। তবে, মুহাম্মদ ইবনে আলী ইবনে মূসার অলৌকিক কেরামতের মাধ্যমে তিনি কারাগার থেকে মুক্ত হন। পুনরায় গ্রেফতার এবং মৃত্যুর ভয়ে তিনি মারভ শহর ছেড়ে হেরাতে পালিয়ে যান এবং সেখানেই জীবনের শেষ দিনগুলো অতিবাহিত করেন।
ইতিহাস অনুযায়ী, মামুন যখন বাগদাদের পথে ছিলেন, তিনি তার উত্তরাধিকারী ইমাম রেযা (আ.) এবং তার মন্ত্রী ফজল ইবনে সোহলকে হত্যা করেন। ফজলকে সেরাখসের একটি গরম পানির ঘরে এবং ইমাম রেযা (আ.)কে সনাবাদের একটি গ্রামে তার পিতামাতা হারুন আল-রশিদের কবরের পাশে সমাহিত করা হয়। সেই সময় "মাশহাদুর -রেজা" নামক কোনো স্থান ছিল না যেখানে আবু সালতকে সমাহিত করা হতে পারে।
গুগল ম্যাপে খাজা আবু সালতের সমাধি থেকে আলী ইবনে মূসা রেজার মাজার পর্যন্ত সরাসরি দূরত্ব ১২.৫ কিলোমিটার এবং সড়কপথে দূরত্ব আরও বেশি হবে। সনাবাদ গ্রামের প্রাচীন এলাকাটি আজকের সনাবাদের সীমানার কাছাকাছি হতে পারে, যা সরাসরি প্রায় ১৫.১৮ কিলোমিটার দূরে। সড়কপথে এই দূরত্ব আরও বেশি হতে পারে।
লেখা: নাজমুল হক (কোম, ইরান)
আপনার কমেন্ট